ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায় – দ্রুত ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়? সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর হলো, ডায়াবেটিসের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা বা পয়েন্ট নেই যেখানে পৌঁছালে মানুষ মারা যায়। তবে, রক্তে শর্করার মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেলে বা কমে গেলে কিছু প্রাণঘাতী অবস্থা তৈরি হতে পারে যা মৃত্যুর কারণ হয়।

 ডায়াবেটিস, যা বহুমূত্র রোগ নামেও পরিচিত, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও এর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

অনেকেই মনে করেন ডায়াবেটিস একটি স্বাভাবিক রোগ, কিন্তু সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়, এর বিভিন্ন দিক এবং দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে।

Table of Contents

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায় ভূমিকাঃ

সরাসরি ডায়াবেটিস একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছালে মানুষ মারা যায় – বিষয়টি এতটা সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে, ডায়াবেটিসের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন জটিলতাই মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে অনেক বেশি থাকলে

তা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন – হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ এবং স্নায়ুতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতিই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা আকস্মিকভাবে অত্যন্ত বেড়ে গেলে বা কমে গেলে তাৎক্ষণিক মৃত্যুও ঘটতে পারে। যেমন:

  • ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (Diabetic Ketoacidosis – DKA): এটি মূলত টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। যখন শরীর শক্তি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত ইনসুলিন পায় না, তখন চর্বি ভাঙতে শুরু করে এবং কিটোন নামক অ্যাসিড তৈরি করে। রক্তে কিটোনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে রক্ত আম্লিক হয়ে পড়ে, যা থেকে কোমাসহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
  • হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপারosmolar স্টেট (Hyperglycemic Hyperosmolar State – HHS): এটি সাধারণত টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের হয়। এক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা চরম পর্যায়ে (প্রায়শই ৬০০ mg/dL বা তার বেশি) পৌঁছে যায় এবং শরীর মারাত্মক ডিহাইড্রেশনে ভোগে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটিও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

সুতরাং, নির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টে মৃত্যু হয় বলার চেয়ে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস যে ধীরে ধীরে বা আকস্মিকভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তা বলাই অধিক যৌক্তিক।

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়, তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। মৃত্যুর কারণ মূলত ডায়াবেটিসের ফলে সৃষ্ট মারাত্মক জটিলতা। তাৎক্ষণিকভাবে, রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে দুটি প্রাণঘাতী অবস্থা তৈরি হতে পারে।

আরো পড়ুনঃ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ইরেক্টিল ডিসফাংসন জন্য ভাল ঔষধ কি জেনে নিন

ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA), যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা সাধারণত ২৫০ mg/dL-এর উপরে থাকে এবং রক্ত অম্লীয় হয়ে যায়। অন্যটি হলো হাইপার osmolar হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট (HHS), যেখানে শর্করার মাত্রা ৬০০ mg/dL-এরও বেশি হতে পারে, যা মারাত্মক পানিশূন্যতা ও কোমা সৃষ্টি করে।

এই দুটি অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু হতে পারে। অন্যদিকে, রক্তে শর্করার মাত্রা খুব কমে গেলেও (সাধারণত ৫৪ mg/dL-এর নিচে) খিঁচুনি বা কোমা হয়ে মৃত্যু ঘটা সম্ভব। তবে, ডায়াবেটিসে অধিকাংশ মৃত্যু হয় দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার কারণে।

বছরের পর বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হৃদরোগ, স্ট্রোক, এবং কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখাই সবচেয়ে জরুরি।

ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি

ডায়াবেটিস প্রধানত কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রকারে বিভক্ত। প্রত্যেকটির কারণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। নিচে প্রধান প্রকারভেদগুলো আলোচনা করা হলো:

  • টাইপ ডায়াবেটিস: এটি একটি অটোইমিউন রোগ। এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে, শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এটি সাধারণত শিশু ও তরুণ বয়সে ধরা পড়ে। এই রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য বাইরে থেকে ইনসুলিন গ্রহণ অপরিহার্য।
  • টাইপ ডায়াবেটিস: এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকারের ডায়াবেটিস। এক্ষেত্রে শরীর হয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অথবা উৎপাদিত ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স)। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, অতিরিক্ত ওজন, জেনেটিক কারণ ইত্যাদি এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes): গর্ভাবস্থায় কিছু মহিলার রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। এটি সাধারণত সন্তান প্রসবের পর সেরে যায়, তবে পরবর্তী জীবনে ঐ মা এবং তার সন্তানের টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • অন্যান্য নির্দিষ্ট প্রকার: কিছু জেনেটিক অবস্থা, নির্দিষ্ট ওষুধ বা অন্যান্য রোগের কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে, যা এই শ্রেণিবিভাগের অন্তর্ভুক্ত।

ডায়াবেটিস এর স্বাভাবিক মাত্রা কত

রক্তে শর্করার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হতে পারে। একে মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা মিলিমোল/লিটার (mmol/L) এককে পরিমাপ করা হয়।

পরীক্ষার অবস্থা স্বাভাবিক মাত্রা (mg/dL) প্রি-ডায়াবেটিস (mg/dL) ডায়াবেটিস (mg/dL)
খালি পেটে (ঘণ্টা) ১০০ এর কম ১০০ – ১২৫ ১২৬ বা তার বেশি
খাওয়ার ঘণ্টা পর ১৪০ এর কম ১৪০ – ১৯৯ ২০০ বা তার বেশি
A1c টেস্ট (গড়) ৫.৭% এর কম ৫.৭% – ৬.৪% ৬.৫% বা তার বেশি

টাইপ ১ ডায়াবেটিসের লক্ষণ সমূহ:

টাইপ ১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো সাধারণত খুব দ্রুত এবং তীব্রভাবে প্রকাশ পায়।

  • ঘন ঘন এবং অতিরিক্ত পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া।
  • অস্বাভাবিকভাবে তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া।
  • প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগা সত্ত্বেও ওজন দ্রুত কমে যাওয়া।
  • তীব্র শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্বলতা।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা।
  • শরীরের কোথাও কেটে গেলে ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া।

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ সমূহ:

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো প্রায়শই ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

  • ঘন ঘন প্রস্রাব এবং অতিরিক্ত তৃষ্ণা।
  • অতিরিক্ত ক্ষুধা।
  • ক্লান্তি ও অবসাদ।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া।
  • হাত বা পায়ে অবশ ভাব বা ঝিনঝিন করা।
  • ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া, বিশেষ করে ত্বক, মাড়ি বা মূত্রনালিতে।
  • ক্ষত শুকাতে বেশি সময় লাগা।

খালি পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল

একজন সুস্থ ব্যক্তির জন্য, ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর (খালি পেটে) রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ১০০ mg/dL (৫.৬ mmol/L) এর কম হওয়া উচিত।

আরো পড়ুনঃ থাইরয়েড নরমাল কত – বাচ্চাদের থাইরয়েড নরমাল কত জেন নিন

ভরা পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল

খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ১৪০ mg/dL (৭.৮ mmol/L) এর কম থাকা উচিত।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল

গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা ভিন্ন হয়। চিকিৎসকেরা সাধারণত নিচের মাত্রাগুলো বজায় রাখার পরামর্শ দেন:

  • খালি পেটে: ৯৫ mg/dL (৫.৩ mmol/L) এর কম।
  • খাবারের ঘণ্টা পর: ১৪০ mg/dL (৭.৮ mmol/L) এর কম।
  • খাবারের ঘণ্টা পর: ১২০ mg/dL (৬.৭ mmol/L) এর কম।

ডায়াবেটিস পয়েন্ট তালিকা (mg/dL)

অবস্থা খালি পেটে (mg/dL) খাওয়ার ঘণ্টা পর (mg/dL) HbA1c (%)
স্বাভাবিক ১০০ এর কম ১৪০ এর কম < ৫.৭%
প্রি-ডায়াবেটিস ১০০ – ১২৫ ১৪০ – ১৯৯ ৫.৭% – ৬.৪%
ডায়াবেটিস ≥ ১২৬ ≥ ২০০ ≥ ৬.৫%
নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ৮০ – ১৩০ ১৮০ এর কম < ৭%
বিপজ্জনক (হাই) ২৫০ এর বেশি ৩০০ এর বেশি
মারাত্মক বিপজ্জনক (হাই) > ৪০০ > ৫০০
বিপজ্জনক (লো) ৭০ এর কম ৭০ এর কম
মারাত্মক বিপজ্জনক (লো) ৫০ এর কম ৫০ এর কম

ডায়াবেটিস কত হলে বিপদ

রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে বা কমে গেলে, দুটি অবস্থাই বিপজ্জনক।

  • হাইপারগ্লাইসেমিয়া (উচ্চ শর্করা): রক্তে শর্করার মাত্রা যদি ক্রমাগত ২৫০ mg/dL এর উপরে থাকে, তবে তা বিপজ্জনক। আর যদি এটি ৩০০-৪০০ mg/dL বা তার বেশি হয়ে যায়, তবে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA) বা হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপারosmolar স্টেট (HHS) এর মতো জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা জীবননাশের কারণ হতে পারে।
  • হাইপোগ্লাইসেমিয়া (নিম্ন শর্করা): রক্তে শর্করার মাত্রা ৭০ mg/dL এর নিচে নেমে গেলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। যদি এটি ৫০ mg/dL এর নিচে চলে যায়, তবে রোগী জ্ঞান হারাতে পারে, কোমায় চলে যেতে পারে এবং এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়

ইনসুলিন নেওয়ার সিদ্ধান্তটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং এটি শুধুমাত্র একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই নিতে পারেন।

  • টাইপ ডায়াবেটিস: এই রোগীদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না, তাই রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথেই তাদের জীবনভর ইনসুলিন নিতে হয়।
  • টাইপ ডায়াবেটিস: প্রাথমিকভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং মুখে খাওয়ার ঔষধের মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। তবে, নিচের ক্ষেত্রগুলোতে ইনসুলিনের প্রয়োজন হতে পারে:
    1. যখন মুখে খাওয়ার ঔষধ এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনেও রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে আসে না (HbA1c সাধারণত ৮% বা ৯% এর বেশি থাকে)।
    2. শরীরে মারাত্মক কোনো সংক্রমণ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা বড় কোনো অপারেশনের সময়।
    3. কিডনি বা লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে, যখন মুখে খাওয়ার ঔষধ ব্যবহার করা নিরাপদ নয়।
    4. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

ডায়াবেটিস রোগের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ডায়াবেটিসকে ‘মধুমেহ’ বলা হয়। এতে চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে অগ্ন্যাশয়কে শক্তিশালী করা। কিছু প্রচলিত আয়ুর্বেদিক উপাদান হলো:

  • করলা: ইনসুলিনের মতো কাজ করে এবং রক্তে শর্করা কমায়।
  • মেথি: এতে থাকা ফাইবার শর্করার শোষণ ধীর করে।
  • আমলকী: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এবং অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা বাড়ায়।
  • জাম: জামের বীজ রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর।
  • গুরমার (Gudmar): একে “চিনি ধ্বংসকারী” বলা হয়, যা মিষ্টি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কমায়।

ডায়াবেটিস রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

হোমিওপ্যাথিতে রোগীর শারীরিক ও মানসিক লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে সামগ্রিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। কোনো নির্দিষ্ট ঔষধ সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। রোগীর ধরণ, রোগের কারণ এবং লক্ষণের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক ঔষধ নির্বাচন করেন।

আরো পড়ুনঃ এম এম কিট খাওয়ার কতোদিন পর বুঝা যায় বাচ্চা নষ্ট হয়েছে 

কিছু ব্যবহৃত ঔষধের মধ্যে রয়েছে সিজিজিয়াম জাম্বোলেনাম (Syzygium Jambolanum), ইউরেনিয়াম নাইট্রিকাম (Uranium Nitricum), এবং ফসফরিক অ্যাসিড (Phosphoric Acid)। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ গ্রহণ করা উচিত নয়।

ডায়াবেটিস রোগের আধুনিক চিকিৎসা

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি হলো তিনটি বিষয়: খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং ঔষধ।

  • খাদ্যাভ্যাস: শর্করা, চর্বি এবং ক্যালোরিযুক্ত খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা। আঁশযুক্ত খাবার, শাকসবজি এবং ফলমূল বেশি করে খাওয়া।
  • ব্যায়াম: সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা, যেমন দ্রুত হাঁটা, সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালানো।
  • ঔষধ: মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট এবং ইনসুলিন ইনজেকশন।

ডায়াবেটিস কত হলে ঔষধ খেতে হবে

সাধারণত, যখন জীবনযাত্রার পরিবর্তন (খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম) করার পরও ৩ মাস ধরে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে (যেমন, খালি পেটে ১২৬ mg/dL এর বেশি বা HbA1c ৬.৫% এর বেশি), তখন চিকিৎসক মুখে খাওয়ার ঔষধ শুরু করার পরামর্শ দেন। প্রি-ডায়াবেটিস পর্যায়েও কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রোগীর ওজন বেশি হলে, চিকিৎসক মেটফরমিন জাতীয় ঔষধ দিতে পারেন।

ডায়াবেটিস এর ঔষধ তালিকা টেবিলসহ

আধুনিক চিকিৎসায় বিভিন্ন শ্রেণির ঔষধ ব্যবহার করা হয়। নিচে কিছু প্রচলিত ঔষধের তালিকা দেওয়া হলো:

ঔষধের শ্রেণি কার্যকারিতা উদাহরণ
বাইগুয়ানাইডস লিভার থেকে গ্লুকোজ উৎপাদন কমায় এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। মেটফরমিন (Metformin)
সালফোনাইলইউরিয়াস অগ্ন্যাশয়কে বেশি ইনসুলিন তৈরিতে উৎসাহিত করে। গ্লিক্লাজাইড (Gliclazide), গ্লিমেপিরাইড (Glimepiride)
ডিপিপি-ইনহিবিটরস ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ায় এবং গ্লুকাগন কমায়। সিটাগ্লিপটিন (Sitagliptin), ভিলডাগ্লিপটিন (Vildagliptin)
এসজিএলটি-ইনহিবিটরস কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সাথে অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করে দেয়। ডাপাগ্লিফ্লোজিন (Dapagliflozin), এম্পাগ্লিফ্লোজিন (Empagliflozin)
থিয়াজোলিডিনডায়োনস শরীরের কোষের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। পায়োগ্লিটাজোন (Pioglitazone)
ইনসুলিন সরাসরি রক্ত থেকে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন প্রকারের শর্ট-অ্যাক্টিং, লং-অ্যাক্টিং ইনসুলিন।

দ্রষ্টব্য: এই তালিকা শুধুমাত্র তথ্যের জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ সেবন বা পরিবর্তন করা যাবে না।

দ্রুত ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে তা দ্রুত কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তবে এটি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করা উচিত।

  • পানি পান করা: পর্যাপ্ত পানি পান করলে তা প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত চিনি শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।
  • ব্যায়াম করা: হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম, যেমন দ্রুত হাঁটা, রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত ব্যবহার করতে সাহায্য করে। তবে শর্করার মাত্রা ২৫০ mg/dL এর বেশি হলে এবং কিটোনের উপস্থিতি থাকলে ব্যায়াম করা উচিত নয়, কারণ এটি মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
  • ইনসুলিন গ্রহণ: যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শর্ট-অ্যাক্টিং ইনসুলিনের একটি ডোজ নেওয়া সবচেয়ে দ্রুত কার্যকরী উপায়।
  • ঔষধ গ্রহণ: কোনো ডোজ বাদ গেলে তা গ্রহণ করা (যদি সময় খুব বেশি পার না হয়ে থাকে)।

দ্রুত ডায়াবেটিস কমানোর ঘরোয়া উপায়

দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং মাঝে মাঝে বেড়ে যাওয়া শর্করা কমাতে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি সহায়ক হতে পারে:

  • ফাইবারযুক্ত খাবার: দ্রবণীয় ফাইবার (যেমন- ওটস, মটরশুঁটি, আপেল) শর্করার শোষণ ধীর করে দেয়।
  • দারুচিনি: গবেষণায় দেখা গেছে, দারুচিনি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে।
  • মেথি ভেজানো পানি: সারারাত মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি পান করা উপকারী।
  • মানসিক চাপ কমানো: যোগব্যায়াম, ধ্যান এবং পর্যাপ্ত ঘুম স্ট্রেস হরমোন কমিয়ে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • নিয়মিত শর্করা মাপা: নিয়মিত রক্তের শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হয়।

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়: উপসংহার

ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক হতে পারে যদি একে অবহেলা করা হয়। রক্তে শর্করার কোনো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় মৃত্যু হয় না, বরং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা যেমন—হৃদরোগ, কিডনি ফেইলিউর, স্ট্রোক, এবং স্নায়ুক্ষয় মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, রক্তে শর্করার মাত্রা अत्यधिक বেড়ে বা কমে গেলে তাৎক্ষণিক জীবননাশের আশঙ্কা থাকে।

আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় কাশি হলে করণীয় – মায়ের স্বাস্থ্য ও শিশুর সুরক্ষা

সুখবর হলো, সঠিক জ্ঞান, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিসকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে একজন ডায়াবেটিস রোগীও অন্যদের মতোই একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন করতে পারেন। তাই আতঙ্কিত না হয়ে, সচেতন হোন এবং ডায়াবেটিসকে জয় করুন।

Author Image
Tanore Computer
আমরা আপনাকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে সবসময় প্রস্তুত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!